বাপি
-জ্যোৎস্না ভট্টাচার্য ত্রিবেদী
দিদি এই দিদি বলনা রে ওই অত তারার মধ্যে কোনটা আমাদের বাপি…..ছোট্ট পাঁচ বছরের ভাইটি প্রশ্ন করে তার চেয়ে তিন বছর এর বড়ো অতি অভিজ্ঞ দিদিকে।
দিদি ও তখন হাঁ করে মাথার ওপর বিশাল আকাশের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে।
ওই দেখ ভাই, ওই যে তারাটা জ্বল জ্বল করছে একটু বড়ো মতো ওটাই বাপি।
ভাইটি হাঁ করে দেখতে থাকে। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে,
দিদি বাপি কবে আসবে রে? আমার যে বড্ডো মন কেমন করে। কত দিন হয়ে গেল বাপি চলে গেছে। এখনো কেন আসছে না বল? আমার যে বড্ডো বাপির কোলে চড়ে বাজার যেতে ঘুরতে যেতে ইচ্ছা করে । বলনা দিদি কবে আসবে বাপি?
দিদি অভিজ্ঞর মতো খালি মাথা নাড়ে। নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকে তারাদের দিকে।
ভাই আবার জিজ্ঞাসা করে আচ্ছা দিদি একটা কথা বল সবার তো মা’রা ঘরেই থাকে কিন্তু আমাদের মা কেন যায় অফিস? আমার একটুও ভালো লাগে না মা’কে ছেড়ে এতক্ষণ থাকতে।
দূর পাগল আমাদের যে বাপি নেই তাই তো মা’ই যায় বাপির অফিসে বাপির মতোই কাজ করতে…ছোট্ট দিদিটি উত্তর দেয়।
ও তাই? তো বাপি কেন তাহলে আসছে না। বাপি কি দেখতে পাচ্ছে না আমার, তোর, মা এর কত কষ্ট। জানিস মা রোজ রাত এ কাঁদে লুকিয়ে লুকিয়ে। তুই তো মার পাশে ঘুমাস না আমি পাশে শুই তাই আমি ঠিক বুঝতে পারি।
আর তাছাড়া আর একটা কথা রে দিদি মা এত সাদা সাদা কাপড় কেন পড়ে? মার তো কতো সুন্দর সুন্দর রঙের শাড়ি আছে। সেগুলো কেন পড়ে না রে। আমার দেখতে একটুও ভালো লাগে না। বড়মা ছোটমা মেজমা’রা কি সুন্দর লাল নীল শাড়ি পড়ে। আর ওই লাল টিপটাও আর মা পরে না। আগে কি সুন্দর দেখাতো বল ওই লাল আর হলুদ রঙের সুন্দর শাড়িটা পরে আর লাল টিপ লাগিয়ে মাকে। সবার চেয়ে সুন্দর দেখাতো তাই না বল দিদি।
এবার দিদি মুখ খোলে… হ্যাঁ রে ভাই। মা’কে খুব সুন্দর লাগতো। কিন্তু মা আর কোনোদিন ওই সব রঙীন শাড়ি আর লাল টিপ পড়বে না রে। আমাদের মা এখন ওই সাদা শাড়িই পড়বে।
কেন? দিদি কেন? সবাই পড়বে আমার মা কেন পড়বে না?
দূর বোকা তুই কিছু জানিস না। আমাদের যে বাবা নেই। ঠাকুরের কাছে চলে গেছে। তাই মা-কে আর ওসব পড়তে নেই। দেখিস নি মা কি আর মাছ খায়? আর সবাই তো খায়। কিন্তু মা তো ঠামমির সাথে আলাদা খায়। আর ওই একাদশীও তো করে ঠাম্মার মতো। দেখিস নি।
হ্যাঁ, দেখেছি তো। কিন্তু এ সব কি বাপি দেখতে পায় না? তবে কেন আসছে না চলে বাপি বল না রে।
না রে ভাই, বাপি আর কোনো দিনই আসবে না। এ বাবা! কে বলেছে তোকে? ভাই তো অত্যন্ত অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
দিদি তখন উদাস স্বরে বলে আমি জানি। বাপি আর ফিরবে না।
ভাই ব্যাকুল হয়ে আবার জিজ্ঞাসা করে.. কেন রে.. বলনা কে বলছে তোকে এ কথা?বলনা দিদি…
ধীর শান্ত মৃদু স্পষ্ট স্বরে বলে দিদি…মা বলেছে।
মা? মা তোকে বলেছে বাপি আর ফিরে আসবে না?
হ্যাঁ রে মা-ই বলেছে। কবে জানিস? সেই দিন যেদিন ভোর রাতে বাপিকে নিয়ে সবাই চলে গেলো। একটা সাদা গাড়ি এসেছিলো জানিস। সবাই বলছিল এম্বুলেন্স এসেছে। সকলে মিলে বাপিকে ধরাধরি করে নামিয়ে নিয়ে গড়িতে ওঠাচ্ছিলো। তখন আমি আর মা এই জানলায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। তখনই মা বলেছিলো…
“মনি বাপিকে দেখে নে শেষ বারের মতো। আর তোর বাপি ফিরবে না রে। আর ফিরবে না।”
সত্যি আর তো বাপি ফেরেনি বাড়ি। সেদিন সন্ধে বেলা জেঠু কাকু আরো কত লোক সবাই বাড়ি আসলো। জেঠু কাঁদতে কাঁদতে ঠামমিকে বললো মা গো পারলাম না ভাইকে ফিরিয়ে আনতে। সবাই কতো কাঁদলো। তুই তো খুব ছোট ছিলি তখন তাই তুই কিছু বুঝিস নি। আর ভোর বেলা বা সারা রাত যে বাপি খুব কষ্ট পেয়েছিলো সে সব ও তুই জানতে পারিস নি। তুই তো ঘুমাচ্ছিলিস। একমাত্র তুইই সেদিন রাতে ঘুমাচ্ছিলিস। আর সবাই জেগে ছিলো।
ভাই খুব চিন্তিত মনে আবার জিজ্ঞাসা করে তবে কি হবে রে দিদি? বাপি কি সত্যি আর আসবে না? কেন? বাপির কি আমাদের দেখতে একটুও ইচ্ছা করে না? বাপি কি আমাদের ভালোবাসতো না রে?
না রে ভাই। বাপি তো খুব ভালোবাসতো। তোকে আমাকে মা’কে ঠামমিকে আর সবাইকে। আর বাপি কি নিজের ইচ্ছায় গেছে বল। ঠাকুরই তো নিয়ে গেছে। আর ঠাকুর যাকে নিয়ে যায় সে আর ফিরতে পারে না রে।
কিন্তু কেন? ঠাকুরের কি বাপি নেই নাকি। আমাদের বাপিকেই নিতে হলো? আর কাউকে পেলো না? ঠাকুর খুব বাজে। খুব বাজে। আমি আর কোনো দিন ঠাকুরকে প্রণাম করবো না। মা যতই বলুক করতে। করবোই না। চোখ জলে ভোরে আসে পাঁচ বছরের ছোট্ট পিতৃ হারা শিশুটির। আর তার হঠাৎ বড়ো হয়ে যাওয়া দিদি তাকে টেনে নয় কাছে। চোখের জল মুছিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে চলে। ভোলানোর চেষ্টা করে চলে। এভাবেই কেটে যায় দিন। মাস। বছর। আস্তে আস্তে সবই স্মৃতি হয়ে যায়। তলিয়ে যায় কত কিছু বিস্মৃতির অন্তরালে।